কথা হচ্ছিল 'বাংলা সিনেমা' নিয়ে। বাংলা সিনেমা কথাটি ঊধর্্ব কমা দিয়ে সীমাবদ্ধ করার কারণ হল এটি এখন অনেক অভিধা, অনেক বিতর্ক বহন করে। যাই হোক, 'বাংলা সিনেমা'-র কথা উঠতেই আমার এক বন্ধু বলল, সে সিনেমাকে দু'ভাগে ভাগ করতে চায়, এক, ভালো ছবি এবং দুই, মন্দ ছবি। এমন অদ্ভুত শ্রেণীবিন্যাস আমার মাথায় কখনও আসেনি। অবশ্য ও বেচারার দোষ আর কি? আজকাল চারপাশে অনেককেই দেখছি ভালো আর খারাপ মেরুকরণে পক্ষপাতি। পাকা শিল্পীদেরও দেখছি। বুঝে হোক বা না বুঝে, তারা যে দায় এড়াচ্ছেন তা বলাই বাহুল্য।
পদ্মাবতী কিংবা বিদ্যাসুন্দর
প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার মানুষ সৌন্দর্যের উপাসক। পদ্মাবতী কিংবা বিদ্যাসুন্দর কাব্যে নায়িকার রূপ বর্ণনা অংশে যেসব ইরোটিক সৌন্দর্য আছে তা পড়তে গেলে আজকের যুগেও অনেকের আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাবে। কিন্তু তখন রসিকেরা নগ্নতার ভেতর থেকেই সৌন্দর্য খুঁড়ে বের করেছে। পাপবোধে নগ্নতাকে না দেখেই দূর দূর করে তাড়ায়নি। তারা জানত সৌন্দর্যের কোনো পাপ নেই। যারা একে পাপ বলে তাদের মনের মধ্যে ময়লা, তাতে রসিকের সৌন্দর্যবোধ ব্যাহত হয় না। নগ্নতার এই সৌন্দর্য কেবল নয়, সামাজিক বন্ধন নিবিড় করার জন্য, নারী-পুরুষের স্বাভাবিক সম্পর্ক গভীরতর করার জন্য এ দেশেই সৃষ্টি হয়েছে কামসূত্র। যা অত্যন্ত উঁচুদরের শিল্প। নগ্নতার এই চর্চার সাথে ন্যায়শাস্ত্র বা ধর্মশাস্ত্রের বিরোধ এসেছে ধীরে ধীরে। কিন্তু একটি বিষয় কেউ খেয়াল করেনি, সেটি হল, বিরোধ যতই এসেছে ততই 'ওপেন সোসাইটি'-র ধারণাটি খর্ব হয়েছে। সামাজিক উদারতা মুখ থুবড়ে পড়েছে। 'নগ্নতা খারাপ'- বিষয়টি এখন এতোই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, স্বাভাবিক সৌন্দর্যও খারাপের পাল্লায় গিয়ে পড়েছে। এই 'সৌন্দর্যের দোষ' সামাজিকভাবে এতোটাই প্রোথিত-শেকড় হয়েছে যে এই সমাজব্যবস্থায় একটি মেয়ে যত বড় আর যত সুন্দর হতে থাকে ততই সে কুঁকড়ে যেতে থাকে। ততই সে দুই হাত দিয়ে তার বুক আড়াল করতে থাকে। সারাক্ষণ কোন এক চোখ তাকে শাসন করতে থাকে, ফলে সে সারাক্ষণ ওড়না টানতে থাকে।
'খারাপ ছবি' নষ্টা মেয়ে প্রসঙ্গে
বাপ-মাকে কন্যাদায়গ্রস্ততা থেকে মুক্তি দিতে দুই বোনের এক বোন সম্মতি না থাকলেও প্রস্তাব আসা বিয়েতে রাজি হয়। কিন্তু দেখা যায় বিয়ের নামে মেয়েটিকে পতিতালয়ে বিক্রি করে সংঘবদ্ধ একটি চক্র। ঐ পতিতালয়ের সরদারনি মেয়েটিকে শরবতে মেশানো ওষুধ খাইয়ে প্রায় অচেতন অবস্থায় এক ধনী কিন্তু বখাটে ছেলের কাছে বিক্রি করে। অচেতন অবস্থায় মেয়েটি ধর্ষনের শিকার হয়। ধনী ছেলেটি মেয়েটিকে অচেতন অবস্থায় ধর্ষন করলেও পরে তার প্রেমে পড়ে যায়। জ্ঞান ফেরার পর মেয়েটি সব বুঝতে পেরে অনেক লড়াই করে বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু সমাজ তথা পরিবার তার এই লড়াইয়ের মূল্য দেয়া তো দূরে থাক, তাকে মেনে না নিয়ে 'নষ্টা মেয়ে' উপাধি জুড়ে দেয়। মেয়েটির কোনো দোষ না থাকার পরও সেই নষ্টা মেয়ে। সমস্ত দায় মাথায় নিয়ে তাকেই নেমে যেতে হয় অন্ধকারে। যাবার আগে মেয়েটি বলে যায় তার বদলে একটি ছেলে যদি অপহৃত হবার পর লড়াই করে কৌশলে বাড়ি ফিরে আসতে পারতো তাহলে লোকে তাকে বাহ্বা দিত।
ধীরে ধীরে নষ্টা মেয়েটি বুঝতে পারে কেবলমাত্র সে যদি ধনী হতে পারে তবেই সে এ সমাজে স্বীকৃত পাবে, তাছাড়া নয়। কাজেই সে নেমে পড়ে ধনী হবার রাস্তায়, সত্যিকার নষ্টা মেয়ে হয়ে যায় সে। অন্যদিকে যে ছেলেটি তাকে ধর্ষন করেছিল সে তার প্রেমে পড়ে তাকে অর্জনের চেষ্টা করতে থাকে। মেয়েটি সমাজের চোখে তথাকথিত নষ্টা জেনেও সে তাকে ভালবাসা নিবেদন করে। কিন্তু মেয়েটির শক্তি হল, সে কোন দয়া-দাক্ষিণ্য নিতে রাজী নয়, সে পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, ছেলেটি তাকে অচেতন অবস্থায় ধর্ষন করেছে বলে যদি কোন অপরাধবোধে ভোগে বলে মনে করে, এবং সেই পাপ স্খলন করতে চায়, তাহলে সে ভুল করবে। কারণ ঐ সস্তা করুণার কোন মূল্য তার কাছে নেই। অবশ্য পরবতর্ীতে তার ভালবাসা খাদহীন বুঝতে পেরে মেয়েটি একসময় তাকে স্বীকৃতি দেয়।
মুটামুটি এরকম কাহিনী নিয়েই নির্মিত ছবি 'নষ্টা মেয়ে'। ছবিটিতে যেমন সমাজের দগদগে ঘা উন্মোচনের প্রয়াস আছে তেমনি আছে কাহিনীর বৈচিত্র্য ও নারী-পুরষ সম্পর্ক নিয়ে নানা ধরনের নিরীক্ষা। সবচেয়ে বড় কথা, সমাজের তথাকথিত দর্শনের প্রতি আছে বিশাল আঘাত। আঘাতটি আছে দু'ভাবে।
এক- সীমা নামের আর্ট কলেজের একটি মেয়ের আত্মহত্যার কথা নিশ্চয়ই আমাদের সকলের মনে আছে। বখাটে ছেলেরা সীমাকে উৎপাত করবে আর সীমা নিরবে সেটা হজম করবে সেটাই চায় আমাদের সমাজ। সমাজ কখনই চায় না সীমা প্রতিবাদ করুক, এমনকি তার বাবা-মাও চায়নি। কারণ তারা ব্যক্তি হিসেবে সীমার আপনজন হলেও সামষ্টিকভাবে সমাজের চিন্তার কাঠামোরই অংশ। কাজেই তারাও সীমার পক্ষে দাঁড়ায়নি। কাজেই সীমার সামনে আত্মহত্যা ছাড়া কোনো পথ খোলা ছিল না। আত্মহত্যার কারণে সীমা সমাজকে আঘাত করতে পারেনি। কয়েকজনের আহা-উহু আদায় করতে পেরেছে মাত্র। কিন্তু আমাদের 'নষ্টা মেয়ে'টি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে, যে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোর কারণেই বিন্দুমাত্র দোষ না থাকার পরও সে-ই যখন দায়ী, সে-ই যখন নষ্টা মেয়ে হিসেবে পরিবার তথা সমাজ থেকে বহিষকৃত, ঐ সমাজ কাঠামোকে সে দেখে নেবে। এই চ্যালেঞ্জটাই হচ্ছে প্রথম আঘাত।
দ্বিতীয় আঘাতটি হল, আমাদের সমাজের যারা তথাকথিত উদার মনোভাবের 'সুশীল সমাজ' তাদের প্রতি। তারা উদার, কিন্তু তারা নগ্নতাকে সহ্য করতে পারেন না। তারা গোপনে ঠিকই নগ্নতা খুঁজে বেড়ান ইন্টারনেটে কিংবা বিদেশি পর্ণো ছবিতে। কিন্তু বাংলা ছবিতে একটু কিছু দেখা গেল তো সব গেলো গেলো বলে চিৎকার জুড়ে দেন। নষ্টা মেয়ে ছবিতে সমাজের যে চেহারা উন্মোচনের চেষ্টা করা হয়েছে সেটি কোনোভাবেই পরিষ্কার করে সবকিছু না দেখিয়ে বোঝানো সম্ভব হতো না। কাহিনীর প্রয়োজনেই কিছু নগ্নতার আশ্রয় নিতে হয়েছে নির্মাতাকে। কিন্তু এই সুশীল সমাজ ওয়ালারা কেবল বাংলা ছবি হওয়ার দোষে তাকে 'অহেতুক অশ্লীলতা' বলে চালানোর অপচেষ্টা চালান। তারা বিদেশি ছবির যৌনতাকে কোনোরকম বিশ্লেষণ ছাড়াই আর্ট এবং কাহিনীর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলে রায় দিয়ে দেন, আর বাংলা ছবিতে নায়িকাদের বোরকা পরার দাবি জানান।
'নষ্টা মেয়ে' এই ধারণার প্রতিও একটি আঘাত। বাংলা ছবিতে নায়ক নায়িকা ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে চুমু খেতে পারবে না, এই অলিখিত ধারণা ভাঙার জন্য এটি আমাদের চেতনায় আঘাত করে। তার চেয়ে বড় কথা, আমাদের সাহিত্যে, বা সিনেমায় বা অন্য কোন মাধ্যমে নারীর অবস্থান মানেই নিষ্ক্রিয়, তার সবচেয়ে বড় সক্রিয়তা সীমার মতো আত্মহত্যা পর্যন্ত, কিন্তু সমাজের তাবত শৃঙ্খলাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, এমনকি অপরাধবোধে দগ্ধ হতে থাকা প্রেমিকটিকেও প্রত্যাখ্যান করার মধ্য দিয়ে যে সক্রিয়তা নষ্টা মেয়েটি হাজির করে তা সত্যি প্রেরণা হবার যোগ্য।
বাংলা ছবির দর্শকরা কোথায় যাবে?
আমাদের দেশের তরুন সমাজ অশ্লীল বাংলা ছবি দেখে বখে যাচ্ছে বলে যারা হাহুতাশ করছেন তারা কি কোনো বিকল্প তাদের জন্য হাজির করেছেন? আপনারা যেসব বাংলা ছবিকে সুস্থ ধারার ছবি বলে চালাতে চাইছেন সত্যি কথা বলতে কি সেসব ছবিতে আদতে কিছুই নেই। না আছে কোনো কাহিনীর নতুনত্ব, সেই একই বস্তাপচা গল্পের জাবর কাটা, না আছে কোনো গ্ল্যামার। লোকে সেই ছবিতে কি দেখবে? আমরা যেসব ছবিকে 'অশ্লীল' বলছি সে ছবিগুলোর গল্পও বস্তাপচা, কিন্তু সেখানে কিছু 'কুইক এন্টারটেইনমেন্ট' আছে, গ্ল্যামার আছে যা মানুষকে আকর্ষণ করে।
আমাদের ছবির দর্শক কারা সেটা যদি বিবেচনা করি তাহলে দেখা যাবে তারা সকলেই খেটে খাওয়া মানুষ। 'ভদ্রলোকদের' ভাষায় নিম্নরুচির মানুষ, ছোটলোক, রিক্সাওয়ালা, দিনমজুর। অনেক সুশীল সমাজওয়ালা আবার ঘটা করে পত্রিকার পাতায় লিখেওছেন যে আজকাল সিনেমা তৈরি হয় রিক্সাওয়ালাদের জন্য। তাদের লেখায় রিক্সাওয়ালা শব্দটি যে মর্যাদা পায়, তাতে মনে হয় এই ছোটলোকদের আবার সিনেমা দেখার দরকার কী? তাদেরকে উনারা দয়া দাক্ষিণ্য করে যে দু-চারটি টাকা দেন তা দিয়ে কোনমতে চাল কিনে ভাত খেয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকা উচিত। শালারা নাকি আবার পয়সা খরচ করে সিনেমা দেখতে যায়। যাই তোক, আমি বলি, তারা সারাদিনের অমানুষিক পরিশ্রম শেষে কষ্টের অর্জিত পয়সা খরচ করে বাংলা ছবি নামের যে বিনোদনটুকু কেনে সেখানে তাদের পয়সা উসুল করার মতো কিছু উপাদান অন্তত আছে যা ঐসব তথাকথিত সুস্থ ধারার ছবিতে নেই। ঐ ভদ্রলোকদের বলি, আপনি তো বাংলা ছবি দেখতে সিনেমা হলে যান না, আপনি তো আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজ বা গ্যেঁটে কিংবা অন্য কোনো কেন্দ্রে ইওরোপের বা আমেরিকার ছবি দেখেন, আপনি নিও রিয়েলিজম দেখেন। তাহলে ঐ ছোটোলোকগুলো কী দেখবে আর কী দেখবে না সেটা আপনি ঠিক করে দিতে চান কেন? আপনি সেসব ছবিকে সুস্থ্য কিংবা অসুস্থ্য বলার কে?
'১৪৪ মিলিয়ন পিপল কান্ট বি রং'
আমরা যেসব বাংলা ছবিকে অশ্লীল ছবি বলছি তার সিংহভাগ দর্শক তরুণ, স্কুল পালানো ছেলে যেমন আছে তেমনি আছে কিশোর বা তরুণ শ্রমিকও। তারুণ্য মানেই বাধন ছেঁড়ার চ্যালেঞ্জ। নিয়ম ভাঙার নেশা। অশ্লীলতা সমাজে নিষিদ্ধ বলেই তারা সেটা দেখার আলাদা আগ্রহ পায়। তাছাড়া যৌনতা ব্যাপারটা জানার, নারী-পুরুষের দৈহিক সৌন্দর্য দেখার আগ্রহ বা অধিকার যাই বলি, দুটোই তাদের আছে। কিন্তু কি সিলেবাসের বিজ্ঞান বইয়ে কি অন্য কোনোভাবে সে এ সম্পর্কে জানতে পারে না। এটি কেবলই নিষিদ্ধ। এ কারণেই স্কুল পালিয়ে সোজা বাংলা সিনেমা। 'লাল-সবুজ' মার্কা বস্তাপচা 'মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি' হোক বা অন্য কোনো তথাকথিত 'সুস্থ্য' ধারার ছবি হোক, এই তরুণদের চাহিদা মেটানোর মতো কোনো কনটেন্ট সেখানে নেই।
একটি এডাল্ট ওয়েব সাইটের শিরোনামে লেখা আছে 'এ পর্যন্ত ১৪৪ মিলিয়ন লোক সাইটটি ভিজিট করেছে। সূতরাং ১৪৪ মিলিয়ন পিপল কান্ট বি রং'। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা অনেকেই এডাল্ট ওয়েব সাইটকে ভুল বলছি, কিন্তু পৃথিবীব্যাপী মিলিয়ন মিলিয়ন লোক এগুলো ভিজিট করছে। তাহলে কোন বাস্তবতাটার ভিত্তি বেশি শক্ত? আমি কিভাবে এতগুলো লোকের আগ্রহকে ভুল বলব? আর সবচেয়ে বড় কথা হল, যৌনতা একটি বাস্তবতা। এমন তো নয় যে যৌনতা মানব সমাজে এক্সিস্ট করে না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এ বিষয়টিকে যত অবদমন করা যাবে তত সমাজের উদার সহনশীলতা কমতে থাকবে।
বাংলা ছবি কারা বন্ধ করতে চায়?
ধরা যাক, আজকে সকল ধরনের অশ্লীল বাংলা ছবি বন্ধ করে দিলাম। তাহলে ঐ হাজার হাজার তরুণ সিনেমা দর্শক কোথায় যাবে? সন্দেহ নেই, যারা এটি বন্ধ করতে আগ্রহী তাদের একটি বড় অংশ ধর্মাচারী। ধর্মাচারীই বললাম, ধর্মান্ধ বললে আরো ভালো হয়। তাদের একাংশ আবার চান ঐ তরুণরা বোমা বানাতে শিখুক, অশ্লীলতা কিংবা উদারতাকে উড়িয়ে দিক, ধ্বংস করে দিক। কিছু তরুণ ঐ জঙ্গিবাদের দিকে যায়ও, কারণ তাতেও চ্যালেঞ্জ আছে। সামনে কোনো বিকল্প না থাকায় সে ঐ চ্যালেঞ্জের দিকেই যাবে।
ইওরোপে বা পশ্চিমে একটি ছেলে আর একটি মেয়ের হাত ধরাধরি করে হাঁটার দৃশ্যই সবচেয়ে স্বাভাবিক দৃশ্য, এমনকি কোনো কোনো দেশে প্রকাশ্যে চুমু খাওয়ার দৃশ্যও অত্যন্ত স্বাভাবিক ও মনোরম। বরং একটি মেয়ে আরেকটি মেয়ের অথবা একটি ছেলের আরেকটি ছেলের হাত ধরে বা গলাগলি ধরে হাঁটার দৃশ্য অস্বাভাবিক এবং ভিন্ন অর্থ প্রকাশক। অথচ আমাদের দেশে একটি মেয়ে আরেকটি মেয়ের এবং একটি ছেলে আরেকটি ছেলের হাত ধরতে শেখে, কারণ একটি মেয়ের আরেকটি ছেলের সহজ ও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাত ধরা আমাদের সমাজের চোখে খারাপ। অথচ নারী-পুরুষ সম্পর্ক সহজ ও স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্য নিয়েই আজ থেকে অনেক বছর আগে আমাদের সমাজেই রচিত হয়েছিল কামসূত্র। যা ইওরোপীয় বা পশ্চিমারা এখান থেকে আমদানী করে নিয়ে গেছে সাদরে। আর আমরা সেটা দূর দূর করে তাড়িয়েছি। অশ্লীল বলেছি, 'কেবলমাত্র প্রাপ্তবয়ষ্কদের জন্য' আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করে রেখেছি। ফলে সমাজে অবদমন সৃষ্টি হয়েছে, ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো আমরা নিষিদ্ধ করেছি বলেই একটি ছেলে আর একটি মেয়ে পরষ্পরকে ভালবেসে চোরের মতো আচরণ করতে থাকে। বাবা-মার কাছে লুকানোর নিরন্তর চেষ্টা করতে থাকে। পালিয়ে বিয়ে করে। ধরা পড়লে ছেলেটির শাস্তি যাই হোক মেয়েটির মাথায় কলঙ্কের আকাশ ভেঙে পড়ে, তার আর কোথাও গ্রহণযোগ্যতা থাকে না, মেয়ের পরিবার একঘরে হয়ে পড়ে।
বাংলা ছবির এখনকার সবচেয়ে বড় শত্রু হল দৈনিক পত্রিকা। কোনো ধরনের বাছ বিচার না করেই ছবিকে তারা দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছে, সুস্থ্য ছবি আর অশ্লীল ছবি। যেসব প্রতিবেদক ক্লান্তিকরভাবে ক্রমাগত লিখে চলেছে কোন হলে কোন অশ্লীল ছবি চলছে, কী কী অশ্লীলতা আছে, গানের কথাগুলো কী কী এবং তা কতটা অশ্লীল ইত্যাদি, তারা মনে করছে তার লেখাটা বোধহয় সমাজ প্রগতির পথে ভূমিকা রাখছে, কিন্তু সে বুঝতেও পারছে না সে কীভাবে মৌলবাদকে উৎসাহিত করছে। এমনও দেখা গেছে, সেই প্রতিবেদক গোপনে ইন্টারনেটে কিংবা অন্য কোথাও পর্ণো ছবি দেখছে। কারণ এটি সত্যি তার প্রয়োজন। কিন্তু সেই প্রয়োজনটা সে বুঝতে পারছে না।
প্রথম আলোর আলপিনের ছিঃনেমা বা আনন্দ, কিছুকাল সাপ্তাহিক ২০০০-এর সিনেমা রিভিউ, হালে সমকালের নন্দনে সিনেমা হল রিপোর্ট কিংবা সংবাদের জলসা যেভাবে বাংলা ছবিকে নিমর্ূল করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে, তাতে মনে হয় যাত্রাশিল্পের মতো বাংলা ছবিও বন্ধ হয়ে গেলে তারা সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাবেন। কারণ কোনো ধরনের দিক নির্দেশনা তাদের লেখায় নেই। তাদের লেখায় ঐ ছবির দর্শকদের রিক্সাওয়ালা বা মজুর বলে গালাগাল করার প্রয়াস আছে। নিম্নরুচি উচ্চরুচি বলে তারা রুচির উদ্ভট শ্রেণীবিভাগ আছে।
এখন সবচেয়ে বেশি দরকার 'চিত্রালী'-র মতো সিনেমা বান্ধব কাগজ। সিনেমার সমালোচনা মানে কোনো ছবিকে নাকচ করে দেয়া নয়। বরং সিনেমাকে জনপ্রিয় করার জন্য চেষ্টা করা। কিন্তু বিপত্তিটা হল, সিনেমা সমালোচকরা সিনেমা কমিউনিটির বাইরের লোক হয়ে গেছেন। এখন সিনেমা ধ্বংস করে দেয়াই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। আমাদের মনে রাখতে হবে, যাত্রা শিল্পে এক ধরনের তথাকথিত 'অশ্লীল' নাচ বন্ধ করে দেয়ার জন্য যাত্রা বন্ধ করে দিয়ে মোটেই প্রগতিশীল কাজ করা হয়নি। বরং জেএমবি-র কাজ সহজ করে দেয়া হয়েছে। আজ অথবা আগামীকাল জেএমবিকে যাত্রা শিল্পে বোমা মারতেই হতো, তার কাজ আপনারাই করে দিয়েছেন। এও মনে রাখতে হবে, ময়মনসিংহে বা সিলেটে সিনেমা হলে যারা বোমা মেরেছে, আপনারা তাদেরই সহযোগিতা করছেন, তাদের কাজ সহজ করে দিচ্ছেন, তারা করতো অজ্ঞ গোঁয়ারের মতো, আর আপনি তা বুদ্ধি দিয়ে করে দিচ্ছেন, জেনে করুন আর না জেনে করুন।
অশ্লীলতা আসলে কী?
সিনেমা দেখার সময় পুরো হল থাকে অন্ধকার। চোখ আর কান এই দুটো ইন্দ্রিয় কেবল কাজ করে। অন্ধকার ও শব্দনিরোধক বলে প্রক্ষিপ্ত ছবি একজন দর্শকের সাথে ইনডিভিজুয়ালি ভাব বিনিময় করে। ফলে ছবির কনটেন্ট যাই হোক তা প্রতিটি দর্শক আলাদাভাবেই উপভোগ করে। অন্ধকার থাকার কারণে পাশের সিটের দর্শকও এই উপভোগে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। কাজেই এখানে কোনোকিছুই শ্লীল বা অশ্লীল নয়। অনেকটা বই পড়ার মতো। বইয়ের পাঠক একজনই হয়। যৌথভাবেও পাঠ হয় বটে কিন্তু তা খুবই সাময়িক, কোনো নোটিশ বা বিজ্ঞপ্তির মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ। কাজেই কোনো বড় লেখা, উপন্যাস বা গল্প একজন পড়লেই তার প্রকৃত আস্বাদন সম্ভব। একজন পড়লে তা কোনোভাবেই অশ্লীল নয়। এ কারণেই লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার কিংবা হেনরি মিলারের অনেক লেখা অশ্লীলতার দোষে অভিযুক্ত হলেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
যখন থেকে টিভি এসেছে তখন এই ধারণার কিছু পরিবর্তন এসেছে। টিভি চলার সময় ঘর অন্ধকার হয় না, টিভির সামনে পরিবারের সবাই বসে থাকে, শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত। কাজেই ব্যক্তিগত আস্বাদন এখানে অসম্ভব। যৌনদৃশ্য দেখে সেজন্য অন্যদের কান গরম হয়। এখান থেকেই 'অশ্লীলতা' ধারণাটির সৃষ্টি। কিন্তু আমরা এখন এ ধারণাটিকেই মৌলিক মনে করছি। ফলে সিনেমায় কনটেন্ট কী থাকবে না থাকবে তার বিতর্ক করছি এই খন্ডিত ও একপেশে ধারণা থেকে।
টিভি কখনও ছবি দেখার জন্য আদর্শ হতে পারে না, কারণ ঘরে যখন টিভি চলে তখন পরিবারের কোনো শিশু হয়তো হইচই করে, কাজের মেয়ে এসে গৃহিণীকে জিজ্ঞেস করে বাটা মাছের সাথে কোন তরকারী দিয়ে রান্না করবে, কলিং বেল বাজিয়ে অতিথি এসে হাজির হয়। সবকিছুকে বজায় রেখেই ছবি দেখতে হয়। ছবি মানে কোনো সিনেমা নয়, নাটক, গান, ডকুমেন্টারি বা যে কোনো কিছু। কাজেই এ ধরনের একটি মাধ্যম যদি শ্লীল অশ্লীল ধারণা সৃষ্টি করে আমরা সেটাকেই মৌলিক বলে ধরে নিই তাহলে বিপত্তি বা বিতর্ক বাধাটাই স্বাভাবিক। কারণ টিভি একটি যৌথপাঠ, যৌথপাঠ বিব্রতকর হতেই পারে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হল, অতীতকাল থেকেই শ্লীলতা অশ্লীলতা বিতর্ক বিদ্যমান। লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার থেকে শুরু করে আমাদের নষ্টা মেয়ে পর্যন্ত। অনেক মামলা, অনেক দ্বন্দ্ব হয়েছে, কিন্তু বিতর্কের কোনো মীমাংসা হয়নি। অশ্লীলতার সর্বজন স্বীকৃত কোনো সংজ্ঞা আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারেননি।
অনেকে বলার চেষ্টা করেছেন '... যা কদর্য, যা মানুষের মনকে কলুষিত করতে পারে তা-ই অশ্লীল ...' ইত্যাদি। কিন্তু বিষয়টি যে তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে গেল। কী কদর্য, কী মানুষের মনকে কলুষিত করবে তাও তো ঠিক হয়নি। এভাবে যতই পেছনে যাওয়া যাবে এ ধরনেরই কোনো না কোনো শব্দ বা ধারণা রয়েই যাবে যার কোনো মীমাংসা নেই।
শিল্প অর্থে চলচ্চিত্র কেবল আর্ট নয়, ইন্ডাস্ট্রিও
বাংলাদেশে আর সব শিল্পের (ইন্ডাস্ট্রি) মতো চলচ্চিত্র শিল্পও মার খেতে চলেছে। এই শিল্পটিরও কোনো পশ্চাত সংযোগ শিল্প (ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি) গড়ে ওঠেনি, ফলে তৈরি হয়নি প্রফেশনালিজম। বড় ধরনের বাজেট এখানে বিনিয়োগ হয়নি। সিনেমার জন্য বাজেট একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, একথা বলাই বাহুল্য। বাজেট নেই বলেই এখনকার বাংলা সিনেমার যৌন কনটেন্টগুলো উৎকর্ষ লাভ করতে পারছে না, সেকারণেই তা কিছুটা স্থুল লাগছে। বাংলা ছবিতে যৌন দৃশ্য যতখানি দেখানো হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি দেখানো হচ্ছে বোম্বের ছবিতে, দক্ষিণ ভারতের ছবি তো আরো একধাপ এগিয়ে। কিন্তু সেগুলো দেখে অশ্লীল মনে হবে না। কারণ সেখানে ব্যবসায়িকভাবে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। সেসব যৌনদৃশ্যে যারা অভিনয় করছেন তারা অনেক বড় শিল্পী, নাচ থেকে শুরু করে অন্যান্য নানা কলায় তারা পেশাগতভাবেই উৎকর্ষ অর্জন করেছেন।
পশ্চাত সংযোগ শিল্প গড়ে উঠলে এখানে আলো, শব্দ, সেট ডিজাইন, সম্পাদনা, ফটোগ্রাফি, সিনেমাটোগ্রাফি এসব বিষয়ে পড়াশোনা থেকে শুরু করে গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষার সুযোগ গড়ে উঠতো। যা সরকারী বা বেসরকারী সকল ধরনের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে এগিয়ে নিতে পারতো। ব্যাপক সংখ্যক উৎসাহী শিক্ষার্থী, গবেষক ছাড়াও প্রফেশনাল গড়ে উঠতো। সর্বোতভাবে যা চলচ্চিত্র শিল্পটিকেই এগিয়ে নিতো। পৃথিবীর খুব কম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেই বছরে শতাধিক বাণিজ্যিক ছবি মুক্তি পায়। কাজেই সে হিসেবে এফডিসি পৃথিবীর কয়েকটি বড় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির একটি। অথচ সেটিই আমরা কত অবহেলায় ধ্বংস করে দিতে উঠে পড়ে লেগেছি। মাথা ব্যথা বলে মাথা কেটে ফেলার প্ল্যান করছি। ইতিমধ্যে তথ্য মন্ত্রণালয় কঠোর আইনও করে ফেলার ঘোষণা দিয়ে ফেলেছে। না জানি কতটা কুপমুন্ডুক আর কতটা রক্ষণশীল আইন তৈরি হচ্ছে। শিল্পের স্বাধীনতা বলে যে বিষয়টি আছে তাকে মেরে ফেলার সমস্ত আয়োজন চূড়ান্ত হতে যাচ্ছে। তখন এই দৈনিক পত্রিকাওয়ালারা নিজেদের যতই প্রগতিশীল বলে দাবি করুক, সিনেমা শিল্প বন্ধ হবার দায় তারা এড়াতে পারবেন না।
'বস্তির রাণী সুরিয়া' ছবিতে নাকি পপি-র শরীর দেখা গেছে, এ বিষয়টি নিয়ে কারা মামলাও করেছে। পপি অবশ্য তা অস্বীকার করেছেন। সত্যি কোনটা আর মিথ্যা কোনটা তার চেয়ে বড় কথা আমরা ভুলে যাচ্ছি একজন শিল্পী হিসেবে একজন ফিল্ম প্রফেশনাল হিসেবে পরিচালকের কথায় পপি ধরে নিলাম শরীর দেখিয়েছেন। এটি কি তার অনেক বড় উচ্চতা নয়? শরীর দেখিয়ে যে আত্মত্যাগ তিনি করেছেন তা অবশ্যই মর্যাদার। শিল্পের স্বার্থে তার একান্ততাকে তিনি উৎসর্গ করেছেন। তার দেখানো পথে প্রফেশনাল কালচারে পরিবর্তন আসবে। টিভি নাটকে আমরা দেখি স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রী এক বিছানায় শুয়েও নিরাপদ একটা দূরত্ব বজায় রাখার এক দৃষ্টিকটূ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। পপির শরীর দেখানো কি এই অশ্লীল চেষ্টার চেয়ে মহত্তর নয়?
অন্ধকার থেকে হঠাৎ আলোয় আসা চোখের যন্ত্রণা
অন্ধকার থেকে আলোয় আসলে চোখ একটু পিট পিট করে। চোখে অস্বাভাবিক লাগে, জ্বালা করে। কিন্তু কিছুক্ষণ আলোয় থাকলে আবার চোখ সয়ে যায়। চোখ না সওয়া পর্যন্ত তাই ধৈর্য ধরতে হয়।
ঢাকায় বা অন্যান্য শহরাঞ্চলে আশির দশকেও সন্ধ্যার পরে রাস্তায় কোনো মেয়ে দেখা যেত না। বিশেষ প্রয়োজনে কেউ বের হয়ে পড়লেও তার দিকে দশজন ঘুরে ঘুরে তাকাতো। অনেকেই মনে করতে নিশ্চয়ই 'পতিতা' হবে। তা না হলে সন্ধ্যার পরে রাস্তায় কেন? কিন্তু যখন গার্মেন্টসের নারী শ্রমিকেরা রাত দশটার পরে দল বেঁধে বাড়ি ফিরতে লাগল তখন একইভাবে অনেকে বলতে শুরু করল দেশটা জাহান্নামের দিকে যাচ্ছে। মেয়েগুলো বেপর্দা ইত্যাদি। এখনকার রেজাল্ট তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। এখন রাত বারোটার সময়ও রাস্তায় মেয়ে দেখলে কারো চোখে অস্বস্তি লাগে না। কারণ চোখ সয়ে এসেছে।
সভ্যদের তাড়া খেয়ে হলিউডের পশ্চিমে পাড়ি
হলিউডে যখন প্রথম দিকে রূপালি পর্দায় চুম্বন বা যৌনতার দৃশ্য দেখা যেতে লাগল তখন নিউইয়র্ক বা ওয়াশিংটনের তথাকথিত ভদ্রলোকেরা এতটাই ছিছিক্কার শুরু করে দিল যে পুরো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে পালিয়ে যেতে হলে পশ্চিমের অসভ্য বন্য সমাজে। সেখানকার রাউডি লোকেরা তাদের সাদরে বরণ করে নিল। কিন্তু পূবের সভ্যদের চোখ সয়ে আসতে বিশেষ সময়ও লাগেনি। তারা এখন আফশোশই করেন, আহা হলিউড লস এঞ্জেলেসে না থেকে যদি ওয়াশিংটন বা নিউইয়র্কে হতো!
আমাদের দেশেও সভ্যদের চোখ জ্বালা শুরু করেছে। কিন্তু চোখ সয়ে আসতেও বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু কথা হল ততদিন ভদ্রলোকদের জোর করে গেলানো পুঁথির কাগজ বোঝাই পেট নিয়ে তোতা পাখি বেঁচে থাকলে হয়।
পদ্মাবতী কিংবা বিদ্যাসুন্দর
প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার মানুষ সৌন্দর্যের উপাসক। পদ্মাবতী কিংবা বিদ্যাসুন্দর কাব্যে নায়িকার রূপ বর্ণনা অংশে যেসব ইরোটিক সৌন্দর্য আছে তা পড়তে গেলে আজকের যুগেও অনেকের আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাবে। কিন্তু তখন রসিকেরা নগ্নতার ভেতর থেকেই সৌন্দর্য খুঁড়ে বের করেছে। পাপবোধে নগ্নতাকে না দেখেই দূর দূর করে তাড়ায়নি। তারা জানত সৌন্দর্যের কোনো পাপ নেই। যারা একে পাপ বলে তাদের মনের মধ্যে ময়লা, তাতে রসিকের সৌন্দর্যবোধ ব্যাহত হয় না। নগ্নতার এই সৌন্দর্য কেবল নয়, সামাজিক বন্ধন নিবিড় করার জন্য, নারী-পুরুষের স্বাভাবিক সম্পর্ক গভীরতর করার জন্য এ দেশেই সৃষ্টি হয়েছে কামসূত্র। যা অত্যন্ত উঁচুদরের শিল্প। নগ্নতার এই চর্চার সাথে ন্যায়শাস্ত্র বা ধর্মশাস্ত্রের বিরোধ এসেছে ধীরে ধীরে। কিন্তু একটি বিষয় কেউ খেয়াল করেনি, সেটি হল, বিরোধ যতই এসেছে ততই 'ওপেন সোসাইটি'-র ধারণাটি খর্ব হয়েছে। সামাজিক উদারতা মুখ থুবড়ে পড়েছে। 'নগ্নতা খারাপ'- বিষয়টি এখন এতোই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, স্বাভাবিক সৌন্দর্যও খারাপের পাল্লায় গিয়ে পড়েছে। এই 'সৌন্দর্যের দোষ' সামাজিকভাবে এতোটাই প্রোথিত-শেকড় হয়েছে যে এই সমাজব্যবস্থায় একটি মেয়ে যত বড় আর যত সুন্দর হতে থাকে ততই সে কুঁকড়ে যেতে থাকে। ততই সে দুই হাত দিয়ে তার বুক আড়াল করতে থাকে। সারাক্ষণ কোন এক চোখ তাকে শাসন করতে থাকে, ফলে সে সারাক্ষণ ওড়না টানতে থাকে।
'খারাপ ছবি' নষ্টা মেয়ে প্রসঙ্গে
বাপ-মাকে কন্যাদায়গ্রস্ততা থেকে মুক্তি দিতে দুই বোনের এক বোন সম্মতি না থাকলেও প্রস্তাব আসা বিয়েতে রাজি হয়। কিন্তু দেখা যায় বিয়ের নামে মেয়েটিকে পতিতালয়ে বিক্রি করে সংঘবদ্ধ একটি চক্র। ঐ পতিতালয়ের সরদারনি মেয়েটিকে শরবতে মেশানো ওষুধ খাইয়ে প্রায় অচেতন অবস্থায় এক ধনী কিন্তু বখাটে ছেলের কাছে বিক্রি করে। অচেতন অবস্থায় মেয়েটি ধর্ষনের শিকার হয়। ধনী ছেলেটি মেয়েটিকে অচেতন অবস্থায় ধর্ষন করলেও পরে তার প্রেমে পড়ে যায়। জ্ঞান ফেরার পর মেয়েটি সব বুঝতে পেরে অনেক লড়াই করে বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু সমাজ তথা পরিবার তার এই লড়াইয়ের মূল্য দেয়া তো দূরে থাক, তাকে মেনে না নিয়ে 'নষ্টা মেয়ে' উপাধি জুড়ে দেয়। মেয়েটির কোনো দোষ না থাকার পরও সেই নষ্টা মেয়ে। সমস্ত দায় মাথায় নিয়ে তাকেই নেমে যেতে হয় অন্ধকারে। যাবার আগে মেয়েটি বলে যায় তার বদলে একটি ছেলে যদি অপহৃত হবার পর লড়াই করে কৌশলে বাড়ি ফিরে আসতে পারতো তাহলে লোকে তাকে বাহ্বা দিত।
ধীরে ধীরে নষ্টা মেয়েটি বুঝতে পারে কেবলমাত্র সে যদি ধনী হতে পারে তবেই সে এ সমাজে স্বীকৃত পাবে, তাছাড়া নয়। কাজেই সে নেমে পড়ে ধনী হবার রাস্তায়, সত্যিকার নষ্টা মেয়ে হয়ে যায় সে। অন্যদিকে যে ছেলেটি তাকে ধর্ষন করেছিল সে তার প্রেমে পড়ে তাকে অর্জনের চেষ্টা করতে থাকে। মেয়েটি সমাজের চোখে তথাকথিত নষ্টা জেনেও সে তাকে ভালবাসা নিবেদন করে। কিন্তু মেয়েটির শক্তি হল, সে কোন দয়া-দাক্ষিণ্য নিতে রাজী নয়, সে পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, ছেলেটি তাকে অচেতন অবস্থায় ধর্ষন করেছে বলে যদি কোন অপরাধবোধে ভোগে বলে মনে করে, এবং সেই পাপ স্খলন করতে চায়, তাহলে সে ভুল করবে। কারণ ঐ সস্তা করুণার কোন মূল্য তার কাছে নেই। অবশ্য পরবতর্ীতে তার ভালবাসা খাদহীন বুঝতে পেরে মেয়েটি একসময় তাকে স্বীকৃতি দেয়।
মুটামুটি এরকম কাহিনী নিয়েই নির্মিত ছবি 'নষ্টা মেয়ে'। ছবিটিতে যেমন সমাজের দগদগে ঘা উন্মোচনের প্রয়াস আছে তেমনি আছে কাহিনীর বৈচিত্র্য ও নারী-পুরষ সম্পর্ক নিয়ে নানা ধরনের নিরীক্ষা। সবচেয়ে বড় কথা, সমাজের তথাকথিত দর্শনের প্রতি আছে বিশাল আঘাত। আঘাতটি আছে দু'ভাবে।
এক- সীমা নামের আর্ট কলেজের একটি মেয়ের আত্মহত্যার কথা নিশ্চয়ই আমাদের সকলের মনে আছে। বখাটে ছেলেরা সীমাকে উৎপাত করবে আর সীমা নিরবে সেটা হজম করবে সেটাই চায় আমাদের সমাজ। সমাজ কখনই চায় না সীমা প্রতিবাদ করুক, এমনকি তার বাবা-মাও চায়নি। কারণ তারা ব্যক্তি হিসেবে সীমার আপনজন হলেও সামষ্টিকভাবে সমাজের চিন্তার কাঠামোরই অংশ। কাজেই তারাও সীমার পক্ষে দাঁড়ায়নি। কাজেই সীমার সামনে আত্মহত্যা ছাড়া কোনো পথ খোলা ছিল না। আত্মহত্যার কারণে সীমা সমাজকে আঘাত করতে পারেনি। কয়েকজনের আহা-উহু আদায় করতে পেরেছে মাত্র। কিন্তু আমাদের 'নষ্টা মেয়ে'টি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে, যে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোর কারণেই বিন্দুমাত্র দোষ না থাকার পরও সে-ই যখন দায়ী, সে-ই যখন নষ্টা মেয়ে হিসেবে পরিবার তথা সমাজ থেকে বহিষকৃত, ঐ সমাজ কাঠামোকে সে দেখে নেবে। এই চ্যালেঞ্জটাই হচ্ছে প্রথম আঘাত।
দ্বিতীয় আঘাতটি হল, আমাদের সমাজের যারা তথাকথিত উদার মনোভাবের 'সুশীল সমাজ' তাদের প্রতি। তারা উদার, কিন্তু তারা নগ্নতাকে সহ্য করতে পারেন না। তারা গোপনে ঠিকই নগ্নতা খুঁজে বেড়ান ইন্টারনেটে কিংবা বিদেশি পর্ণো ছবিতে। কিন্তু বাংলা ছবিতে একটু কিছু দেখা গেল তো সব গেলো গেলো বলে চিৎকার জুড়ে দেন। নষ্টা মেয়ে ছবিতে সমাজের যে চেহারা উন্মোচনের চেষ্টা করা হয়েছে সেটি কোনোভাবেই পরিষ্কার করে সবকিছু না দেখিয়ে বোঝানো সম্ভব হতো না। কাহিনীর প্রয়োজনেই কিছু নগ্নতার আশ্রয় নিতে হয়েছে নির্মাতাকে। কিন্তু এই সুশীল সমাজ ওয়ালারা কেবল বাংলা ছবি হওয়ার দোষে তাকে 'অহেতুক অশ্লীলতা' বলে চালানোর অপচেষ্টা চালান। তারা বিদেশি ছবির যৌনতাকে কোনোরকম বিশ্লেষণ ছাড়াই আর্ট এবং কাহিনীর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলে রায় দিয়ে দেন, আর বাংলা ছবিতে নায়িকাদের বোরকা পরার দাবি জানান।
'নষ্টা মেয়ে' এই ধারণার প্রতিও একটি আঘাত। বাংলা ছবিতে নায়ক নায়িকা ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে চুমু খেতে পারবে না, এই অলিখিত ধারণা ভাঙার জন্য এটি আমাদের চেতনায় আঘাত করে। তার চেয়ে বড় কথা, আমাদের সাহিত্যে, বা সিনেমায় বা অন্য কোন মাধ্যমে নারীর অবস্থান মানেই নিষ্ক্রিয়, তার সবচেয়ে বড় সক্রিয়তা সীমার মতো আত্মহত্যা পর্যন্ত, কিন্তু সমাজের তাবত শৃঙ্খলাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, এমনকি অপরাধবোধে দগ্ধ হতে থাকা প্রেমিকটিকেও প্রত্যাখ্যান করার মধ্য দিয়ে যে সক্রিয়তা নষ্টা মেয়েটি হাজির করে তা সত্যি প্রেরণা হবার যোগ্য।
বাংলা ছবির দর্শকরা কোথায় যাবে?
আমাদের দেশের তরুন সমাজ অশ্লীল বাংলা ছবি দেখে বখে যাচ্ছে বলে যারা হাহুতাশ করছেন তারা কি কোনো বিকল্প তাদের জন্য হাজির করেছেন? আপনারা যেসব বাংলা ছবিকে সুস্থ ধারার ছবি বলে চালাতে চাইছেন সত্যি কথা বলতে কি সেসব ছবিতে আদতে কিছুই নেই। না আছে কোনো কাহিনীর নতুনত্ব, সেই একই বস্তাপচা গল্পের জাবর কাটা, না আছে কোনো গ্ল্যামার। লোকে সেই ছবিতে কি দেখবে? আমরা যেসব ছবিকে 'অশ্লীল' বলছি সে ছবিগুলোর গল্পও বস্তাপচা, কিন্তু সেখানে কিছু 'কুইক এন্টারটেইনমেন্ট' আছে, গ্ল্যামার আছে যা মানুষকে আকর্ষণ করে।
আমাদের ছবির দর্শক কারা সেটা যদি বিবেচনা করি তাহলে দেখা যাবে তারা সকলেই খেটে খাওয়া মানুষ। 'ভদ্রলোকদের' ভাষায় নিম্নরুচির মানুষ, ছোটলোক, রিক্সাওয়ালা, দিনমজুর। অনেক সুশীল সমাজওয়ালা আবার ঘটা করে পত্রিকার পাতায় লিখেওছেন যে আজকাল সিনেমা তৈরি হয় রিক্সাওয়ালাদের জন্য। তাদের লেখায় রিক্সাওয়ালা শব্দটি যে মর্যাদা পায়, তাতে মনে হয় এই ছোটলোকদের আবার সিনেমা দেখার দরকার কী? তাদেরকে উনারা দয়া দাক্ষিণ্য করে যে দু-চারটি টাকা দেন তা দিয়ে কোনমতে চাল কিনে ভাত খেয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকা উচিত। শালারা নাকি আবার পয়সা খরচ করে সিনেমা দেখতে যায়। যাই তোক, আমি বলি, তারা সারাদিনের অমানুষিক পরিশ্রম শেষে কষ্টের অর্জিত পয়সা খরচ করে বাংলা ছবি নামের যে বিনোদনটুকু কেনে সেখানে তাদের পয়সা উসুল করার মতো কিছু উপাদান অন্তত আছে যা ঐসব তথাকথিত সুস্থ ধারার ছবিতে নেই। ঐ ভদ্রলোকদের বলি, আপনি তো বাংলা ছবি দেখতে সিনেমা হলে যান না, আপনি তো আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজ বা গ্যেঁটে কিংবা অন্য কোনো কেন্দ্রে ইওরোপের বা আমেরিকার ছবি দেখেন, আপনি নিও রিয়েলিজম দেখেন। তাহলে ঐ ছোটোলোকগুলো কী দেখবে আর কী দেখবে না সেটা আপনি ঠিক করে দিতে চান কেন? আপনি সেসব ছবিকে সুস্থ্য কিংবা অসুস্থ্য বলার কে?
'১৪৪ মিলিয়ন পিপল কান্ট বি রং'
আমরা যেসব বাংলা ছবিকে অশ্লীল ছবি বলছি তার সিংহভাগ দর্শক তরুণ, স্কুল পালানো ছেলে যেমন আছে তেমনি আছে কিশোর বা তরুণ শ্রমিকও। তারুণ্য মানেই বাধন ছেঁড়ার চ্যালেঞ্জ। নিয়ম ভাঙার নেশা। অশ্লীলতা সমাজে নিষিদ্ধ বলেই তারা সেটা দেখার আলাদা আগ্রহ পায়। তাছাড়া যৌনতা ব্যাপারটা জানার, নারী-পুরুষের দৈহিক সৌন্দর্য দেখার আগ্রহ বা অধিকার যাই বলি, দুটোই তাদের আছে। কিন্তু কি সিলেবাসের বিজ্ঞান বইয়ে কি অন্য কোনোভাবে সে এ সম্পর্কে জানতে পারে না। এটি কেবলই নিষিদ্ধ। এ কারণেই স্কুল পালিয়ে সোজা বাংলা সিনেমা। 'লাল-সবুজ' মার্কা বস্তাপচা 'মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি' হোক বা অন্য কোনো তথাকথিত 'সুস্থ্য' ধারার ছবি হোক, এই তরুণদের চাহিদা মেটানোর মতো কোনো কনটেন্ট সেখানে নেই।
একটি এডাল্ট ওয়েব সাইটের শিরোনামে লেখা আছে 'এ পর্যন্ত ১৪৪ মিলিয়ন লোক সাইটটি ভিজিট করেছে। সূতরাং ১৪৪ মিলিয়ন পিপল কান্ট বি রং'। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা অনেকেই এডাল্ট ওয়েব সাইটকে ভুল বলছি, কিন্তু পৃথিবীব্যাপী মিলিয়ন মিলিয়ন লোক এগুলো ভিজিট করছে। তাহলে কোন বাস্তবতাটার ভিত্তি বেশি শক্ত? আমি কিভাবে এতগুলো লোকের আগ্রহকে ভুল বলব? আর সবচেয়ে বড় কথা হল, যৌনতা একটি বাস্তবতা। এমন তো নয় যে যৌনতা মানব সমাজে এক্সিস্ট করে না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এ বিষয়টিকে যত অবদমন করা যাবে তত সমাজের উদার সহনশীলতা কমতে থাকবে।
বাংলা ছবি কারা বন্ধ করতে চায়?
ধরা যাক, আজকে সকল ধরনের অশ্লীল বাংলা ছবি বন্ধ করে দিলাম। তাহলে ঐ হাজার হাজার তরুণ সিনেমা দর্শক কোথায় যাবে? সন্দেহ নেই, যারা এটি বন্ধ করতে আগ্রহী তাদের একটি বড় অংশ ধর্মাচারী। ধর্মাচারীই বললাম, ধর্মান্ধ বললে আরো ভালো হয়। তাদের একাংশ আবার চান ঐ তরুণরা বোমা বানাতে শিখুক, অশ্লীলতা কিংবা উদারতাকে উড়িয়ে দিক, ধ্বংস করে দিক। কিছু তরুণ ঐ জঙ্গিবাদের দিকে যায়ও, কারণ তাতেও চ্যালেঞ্জ আছে। সামনে কোনো বিকল্প না থাকায় সে ঐ চ্যালেঞ্জের দিকেই যাবে।
ইওরোপে বা পশ্চিমে একটি ছেলে আর একটি মেয়ের হাত ধরাধরি করে হাঁটার দৃশ্যই সবচেয়ে স্বাভাবিক দৃশ্য, এমনকি কোনো কোনো দেশে প্রকাশ্যে চুমু খাওয়ার দৃশ্যও অত্যন্ত স্বাভাবিক ও মনোরম। বরং একটি মেয়ে আরেকটি মেয়ের অথবা একটি ছেলের আরেকটি ছেলের হাত ধরে বা গলাগলি ধরে হাঁটার দৃশ্য অস্বাভাবিক এবং ভিন্ন অর্থ প্রকাশক। অথচ আমাদের দেশে একটি মেয়ে আরেকটি মেয়ের এবং একটি ছেলে আরেকটি ছেলের হাত ধরতে শেখে, কারণ একটি মেয়ের আরেকটি ছেলের সহজ ও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাত ধরা আমাদের সমাজের চোখে খারাপ। অথচ নারী-পুরুষ সম্পর্ক সহজ ও স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্য নিয়েই আজ থেকে অনেক বছর আগে আমাদের সমাজেই রচিত হয়েছিল কামসূত্র। যা ইওরোপীয় বা পশ্চিমারা এখান থেকে আমদানী করে নিয়ে গেছে সাদরে। আর আমরা সেটা দূর দূর করে তাড়িয়েছি। অশ্লীল বলেছি, 'কেবলমাত্র প্রাপ্তবয়ষ্কদের জন্য' আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করে রেখেছি। ফলে সমাজে অবদমন সৃষ্টি হয়েছে, ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো আমরা নিষিদ্ধ করেছি বলেই একটি ছেলে আর একটি মেয়ে পরষ্পরকে ভালবেসে চোরের মতো আচরণ করতে থাকে। বাবা-মার কাছে লুকানোর নিরন্তর চেষ্টা করতে থাকে। পালিয়ে বিয়ে করে। ধরা পড়লে ছেলেটির শাস্তি যাই হোক মেয়েটির মাথায় কলঙ্কের আকাশ ভেঙে পড়ে, তার আর কোথাও গ্রহণযোগ্যতা থাকে না, মেয়ের পরিবার একঘরে হয়ে পড়ে।
বাংলা ছবির এখনকার সবচেয়ে বড় শত্রু হল দৈনিক পত্রিকা। কোনো ধরনের বাছ বিচার না করেই ছবিকে তারা দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছে, সুস্থ্য ছবি আর অশ্লীল ছবি। যেসব প্রতিবেদক ক্লান্তিকরভাবে ক্রমাগত লিখে চলেছে কোন হলে কোন অশ্লীল ছবি চলছে, কী কী অশ্লীলতা আছে, গানের কথাগুলো কী কী এবং তা কতটা অশ্লীল ইত্যাদি, তারা মনে করছে তার লেখাটা বোধহয় সমাজ প্রগতির পথে ভূমিকা রাখছে, কিন্তু সে বুঝতেও পারছে না সে কীভাবে মৌলবাদকে উৎসাহিত করছে। এমনও দেখা গেছে, সেই প্রতিবেদক গোপনে ইন্টারনেটে কিংবা অন্য কোথাও পর্ণো ছবি দেখছে। কারণ এটি সত্যি তার প্রয়োজন। কিন্তু সেই প্রয়োজনটা সে বুঝতে পারছে না।
প্রথম আলোর আলপিনের ছিঃনেমা বা আনন্দ, কিছুকাল সাপ্তাহিক ২০০০-এর সিনেমা রিভিউ, হালে সমকালের নন্দনে সিনেমা হল রিপোর্ট কিংবা সংবাদের জলসা যেভাবে বাংলা ছবিকে নিমর্ূল করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে, তাতে মনে হয় যাত্রাশিল্পের মতো বাংলা ছবিও বন্ধ হয়ে গেলে তারা সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাবেন। কারণ কোনো ধরনের দিক নির্দেশনা তাদের লেখায় নেই। তাদের লেখায় ঐ ছবির দর্শকদের রিক্সাওয়ালা বা মজুর বলে গালাগাল করার প্রয়াস আছে। নিম্নরুচি উচ্চরুচি বলে তারা রুচির উদ্ভট শ্রেণীবিভাগ আছে।
এখন সবচেয়ে বেশি দরকার 'চিত্রালী'-র মতো সিনেমা বান্ধব কাগজ। সিনেমার সমালোচনা মানে কোনো ছবিকে নাকচ করে দেয়া নয়। বরং সিনেমাকে জনপ্রিয় করার জন্য চেষ্টা করা। কিন্তু বিপত্তিটা হল, সিনেমা সমালোচকরা সিনেমা কমিউনিটির বাইরের লোক হয়ে গেছেন। এখন সিনেমা ধ্বংস করে দেয়াই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। আমাদের মনে রাখতে হবে, যাত্রা শিল্পে এক ধরনের তথাকথিত 'অশ্লীল' নাচ বন্ধ করে দেয়ার জন্য যাত্রা বন্ধ করে দিয়ে মোটেই প্রগতিশীল কাজ করা হয়নি। বরং জেএমবি-র কাজ সহজ করে দেয়া হয়েছে। আজ অথবা আগামীকাল জেএমবিকে যাত্রা শিল্পে বোমা মারতেই হতো, তার কাজ আপনারাই করে দিয়েছেন। এও মনে রাখতে হবে, ময়মনসিংহে বা সিলেটে সিনেমা হলে যারা বোমা মেরেছে, আপনারা তাদেরই সহযোগিতা করছেন, তাদের কাজ সহজ করে দিচ্ছেন, তারা করতো অজ্ঞ গোঁয়ারের মতো, আর আপনি তা বুদ্ধি দিয়ে করে দিচ্ছেন, জেনে করুন আর না জেনে করুন।
অশ্লীলতা আসলে কী?
সিনেমা দেখার সময় পুরো হল থাকে অন্ধকার। চোখ আর কান এই দুটো ইন্দ্রিয় কেবল কাজ করে। অন্ধকার ও শব্দনিরোধক বলে প্রক্ষিপ্ত ছবি একজন দর্শকের সাথে ইনডিভিজুয়ালি ভাব বিনিময় করে। ফলে ছবির কনটেন্ট যাই হোক তা প্রতিটি দর্শক আলাদাভাবেই উপভোগ করে। অন্ধকার থাকার কারণে পাশের সিটের দর্শকও এই উপভোগে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। কাজেই এখানে কোনোকিছুই শ্লীল বা অশ্লীল নয়। অনেকটা বই পড়ার মতো। বইয়ের পাঠক একজনই হয়। যৌথভাবেও পাঠ হয় বটে কিন্তু তা খুবই সাময়িক, কোনো নোটিশ বা বিজ্ঞপ্তির মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ। কাজেই কোনো বড় লেখা, উপন্যাস বা গল্প একজন পড়লেই তার প্রকৃত আস্বাদন সম্ভব। একজন পড়লে তা কোনোভাবেই অশ্লীল নয়। এ কারণেই লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার কিংবা হেনরি মিলারের অনেক লেখা অশ্লীলতার দোষে অভিযুক্ত হলেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
যখন থেকে টিভি এসেছে তখন এই ধারণার কিছু পরিবর্তন এসেছে। টিভি চলার সময় ঘর অন্ধকার হয় না, টিভির সামনে পরিবারের সবাই বসে থাকে, শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত। কাজেই ব্যক্তিগত আস্বাদন এখানে অসম্ভব। যৌনদৃশ্য দেখে সেজন্য অন্যদের কান গরম হয়। এখান থেকেই 'অশ্লীলতা' ধারণাটির সৃষ্টি। কিন্তু আমরা এখন এ ধারণাটিকেই মৌলিক মনে করছি। ফলে সিনেমায় কনটেন্ট কী থাকবে না থাকবে তার বিতর্ক করছি এই খন্ডিত ও একপেশে ধারণা থেকে।
টিভি কখনও ছবি দেখার জন্য আদর্শ হতে পারে না, কারণ ঘরে যখন টিভি চলে তখন পরিবারের কোনো শিশু হয়তো হইচই করে, কাজের মেয়ে এসে গৃহিণীকে জিজ্ঞেস করে বাটা মাছের সাথে কোন তরকারী দিয়ে রান্না করবে, কলিং বেল বাজিয়ে অতিথি এসে হাজির হয়। সবকিছুকে বজায় রেখেই ছবি দেখতে হয়। ছবি মানে কোনো সিনেমা নয়, নাটক, গান, ডকুমেন্টারি বা যে কোনো কিছু। কাজেই এ ধরনের একটি মাধ্যম যদি শ্লীল অশ্লীল ধারণা সৃষ্টি করে আমরা সেটাকেই মৌলিক বলে ধরে নিই তাহলে বিপত্তি বা বিতর্ক বাধাটাই স্বাভাবিক। কারণ টিভি একটি যৌথপাঠ, যৌথপাঠ বিব্রতকর হতেই পারে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হল, অতীতকাল থেকেই শ্লীলতা অশ্লীলতা বিতর্ক বিদ্যমান। লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার থেকে শুরু করে আমাদের নষ্টা মেয়ে পর্যন্ত। অনেক মামলা, অনেক দ্বন্দ্ব হয়েছে, কিন্তু বিতর্কের কোনো মীমাংসা হয়নি। অশ্লীলতার সর্বজন স্বীকৃত কোনো সংজ্ঞা আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারেননি।
অনেকে বলার চেষ্টা করেছেন '... যা কদর্য, যা মানুষের মনকে কলুষিত করতে পারে তা-ই অশ্লীল ...' ইত্যাদি। কিন্তু বিষয়টি যে তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে গেল। কী কদর্য, কী মানুষের মনকে কলুষিত করবে তাও তো ঠিক হয়নি। এভাবে যতই পেছনে যাওয়া যাবে এ ধরনেরই কোনো না কোনো শব্দ বা ধারণা রয়েই যাবে যার কোনো মীমাংসা নেই।
শিল্প অর্থে চলচ্চিত্র কেবল আর্ট নয়, ইন্ডাস্ট্রিও
বাংলাদেশে আর সব শিল্পের (ইন্ডাস্ট্রি) মতো চলচ্চিত্র শিল্পও মার খেতে চলেছে। এই শিল্পটিরও কোনো পশ্চাত সংযোগ শিল্প (ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি) গড়ে ওঠেনি, ফলে তৈরি হয়নি প্রফেশনালিজম। বড় ধরনের বাজেট এখানে বিনিয়োগ হয়নি। সিনেমার জন্য বাজেট একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, একথা বলাই বাহুল্য। বাজেট নেই বলেই এখনকার বাংলা সিনেমার যৌন কনটেন্টগুলো উৎকর্ষ লাভ করতে পারছে না, সেকারণেই তা কিছুটা স্থুল লাগছে। বাংলা ছবিতে যৌন দৃশ্য যতখানি দেখানো হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি দেখানো হচ্ছে বোম্বের ছবিতে, দক্ষিণ ভারতের ছবি তো আরো একধাপ এগিয়ে। কিন্তু সেগুলো দেখে অশ্লীল মনে হবে না। কারণ সেখানে ব্যবসায়িকভাবে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। সেসব যৌনদৃশ্যে যারা অভিনয় করছেন তারা অনেক বড় শিল্পী, নাচ থেকে শুরু করে অন্যান্য নানা কলায় তারা পেশাগতভাবেই উৎকর্ষ অর্জন করেছেন।
পশ্চাত সংযোগ শিল্প গড়ে উঠলে এখানে আলো, শব্দ, সেট ডিজাইন, সম্পাদনা, ফটোগ্রাফি, সিনেমাটোগ্রাফি এসব বিষয়ে পড়াশোনা থেকে শুরু করে গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষার সুযোগ গড়ে উঠতো। যা সরকারী বা বেসরকারী সকল ধরনের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে এগিয়ে নিতে পারতো। ব্যাপক সংখ্যক উৎসাহী শিক্ষার্থী, গবেষক ছাড়াও প্রফেশনাল গড়ে উঠতো। সর্বোতভাবে যা চলচ্চিত্র শিল্পটিকেই এগিয়ে নিতো। পৃথিবীর খুব কম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেই বছরে শতাধিক বাণিজ্যিক ছবি মুক্তি পায়। কাজেই সে হিসেবে এফডিসি পৃথিবীর কয়েকটি বড় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির একটি। অথচ সেটিই আমরা কত অবহেলায় ধ্বংস করে দিতে উঠে পড়ে লেগেছি। মাথা ব্যথা বলে মাথা কেটে ফেলার প্ল্যান করছি। ইতিমধ্যে তথ্য মন্ত্রণালয় কঠোর আইনও করে ফেলার ঘোষণা দিয়ে ফেলেছে। না জানি কতটা কুপমুন্ডুক আর কতটা রক্ষণশীল আইন তৈরি হচ্ছে। শিল্পের স্বাধীনতা বলে যে বিষয়টি আছে তাকে মেরে ফেলার সমস্ত আয়োজন চূড়ান্ত হতে যাচ্ছে। তখন এই দৈনিক পত্রিকাওয়ালারা নিজেদের যতই প্রগতিশীল বলে দাবি করুক, সিনেমা শিল্প বন্ধ হবার দায় তারা এড়াতে পারবেন না।
'বস্তির রাণী সুরিয়া' ছবিতে নাকি পপি-র শরীর দেখা গেছে, এ বিষয়টি নিয়ে কারা মামলাও করেছে। পপি অবশ্য তা অস্বীকার করেছেন। সত্যি কোনটা আর মিথ্যা কোনটা তার চেয়ে বড় কথা আমরা ভুলে যাচ্ছি একজন শিল্পী হিসেবে একজন ফিল্ম প্রফেশনাল হিসেবে পরিচালকের কথায় পপি ধরে নিলাম শরীর দেখিয়েছেন। এটি কি তার অনেক বড় উচ্চতা নয়? শরীর দেখিয়ে যে আত্মত্যাগ তিনি করেছেন তা অবশ্যই মর্যাদার। শিল্পের স্বার্থে তার একান্ততাকে তিনি উৎসর্গ করেছেন। তার দেখানো পথে প্রফেশনাল কালচারে পরিবর্তন আসবে। টিভি নাটকে আমরা দেখি স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রী এক বিছানায় শুয়েও নিরাপদ একটা দূরত্ব বজায় রাখার এক দৃষ্টিকটূ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। পপির শরীর দেখানো কি এই অশ্লীল চেষ্টার চেয়ে মহত্তর নয়?
অন্ধকার থেকে হঠাৎ আলোয় আসা চোখের যন্ত্রণা
অন্ধকার থেকে আলোয় আসলে চোখ একটু পিট পিট করে। চোখে অস্বাভাবিক লাগে, জ্বালা করে। কিন্তু কিছুক্ষণ আলোয় থাকলে আবার চোখ সয়ে যায়। চোখ না সওয়া পর্যন্ত তাই ধৈর্য ধরতে হয়।
ঢাকায় বা অন্যান্য শহরাঞ্চলে আশির দশকেও সন্ধ্যার পরে রাস্তায় কোনো মেয়ে দেখা যেত না। বিশেষ প্রয়োজনে কেউ বের হয়ে পড়লেও তার দিকে দশজন ঘুরে ঘুরে তাকাতো। অনেকেই মনে করতে নিশ্চয়ই 'পতিতা' হবে। তা না হলে সন্ধ্যার পরে রাস্তায় কেন? কিন্তু যখন গার্মেন্টসের নারী শ্রমিকেরা রাত দশটার পরে দল বেঁধে বাড়ি ফিরতে লাগল তখন একইভাবে অনেকে বলতে শুরু করল দেশটা জাহান্নামের দিকে যাচ্ছে। মেয়েগুলো বেপর্দা ইত্যাদি। এখনকার রেজাল্ট তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। এখন রাত বারোটার সময়ও রাস্তায় মেয়ে দেখলে কারো চোখে অস্বস্তি লাগে না। কারণ চোখ সয়ে এসেছে।
সভ্যদের তাড়া খেয়ে হলিউডের পশ্চিমে পাড়ি
হলিউডে যখন প্রথম দিকে রূপালি পর্দায় চুম্বন বা যৌনতার দৃশ্য দেখা যেতে লাগল তখন নিউইয়র্ক বা ওয়াশিংটনের তথাকথিত ভদ্রলোকেরা এতটাই ছিছিক্কার শুরু করে দিল যে পুরো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে পালিয়ে যেতে হলে পশ্চিমের অসভ্য বন্য সমাজে। সেখানকার রাউডি লোকেরা তাদের সাদরে বরণ করে নিল। কিন্তু পূবের সভ্যদের চোখ সয়ে আসতে বিশেষ সময়ও লাগেনি। তারা এখন আফশোশই করেন, আহা হলিউড লস এঞ্জেলেসে না থেকে যদি ওয়াশিংটন বা নিউইয়র্কে হতো!
আমাদের দেশেও সভ্যদের চোখ জ্বালা শুরু করেছে। কিন্তু চোখ সয়ে আসতেও বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু কথা হল ততদিন ভদ্রলোকদের জোর করে গেলানো পুঁথির কাগজ বোঝাই পেট নিয়ে তোতা পাখি বেঁচে থাকলে হয়।
No comments:
Post a Comment